বর্ণ পরিচয়

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বর্ণ পরিচয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত একটি গ্রন্থের নাম। এতে তিনি বাংলা লিপির ব্যাপক সংস্কার ও উন্নয়নের প্রস্তাব করেন। এই বইয়ের প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয় ১ বৈশাখ, ১২৬২ বঙ্গাব্দে, ইংরেজি ১৩ এপ্রিল ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে। কলকাতার ১ নম্বর কলেজ স্কোয়ারের ‘সংস্কৃতযন্ত্র’ নামের প্রেস থেকে ২০টি পাঠে বিভক্ত ৩০ পৃষ্ঠার এ বইটির দাম ছিল ‘দুই পয়সা’ মাত্র! বিদ্যাসাগরের এই ক্ষীণতনু স্বল্পমূল্যের বইটি সমাজে তার ভূমিকা ও প্রভাবের দিক থেকে অতুলনীয়। আধুনিক বাংলাভাষা ও সাহিত্যের বিকাশের পেছনে এ বইটির ভূমিকা যেন জন্মদাত্রীর। আমরা লিখিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জগতে তাঁর হাত ধরেই প্রবেশ করলাম। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যথার্থই লিখেছেন, "ইনি সর্বপ্রথম বাঙ্গালীকে বিশুদ্ধ বাঙ্গালা শিখাইয়াছেন।" রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরকে আখ্যায়িত করেছেন বাংলাভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী’ হিসেবে। কারণ তিনিই ‘সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন।’ (বিদ্যাসাগর চরিত) আর আচার্য সুনীতিকুমারের ভাষায়, ‘বাঙ্গালা গদ্যে প্রতিভার প্রথম স্মরণ-বিদ্যাসাগর।’

সূচিপত্র

[সম্পাদনা] বৈশিষ্ট্যসমূহ

এরপর আবারও ১২৫ বছরে কেবল অন্তস্থ ‘ব’ টি ব্যঞ্জন থেকে বাদ গিয়েছে। ফলে বলা যায়, আধুনিক বাংলা বর্ণমালার মূল রূপকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

[সম্পাদনা] দ্বিতীয়

তাঁর বর্ণপরিচয় এর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এই প্রথম শিশুদের উপযোগী সহজবোধ্য ও সংক্ষিপ্ত বাক্য দিয়ে পাঠ রচনা করা হয়েছে। এখানে প্রথমে শিশু বর্ণক্রমিক পদ্ধতিতে বর্ণ শিখবে, বর্ণের সঙ্গে মুখে মুখে ছোট ছোট শব্দ শিখবে, এরপর বর্ণপরিচয়-এর পরীক্ষা, তারপর বর্ণযোজনা ও ফলা সংযোগে বানান শেখার সূচনা। এরপর রয়েছে সহজবোধ্য ছোট বাক্যের ছোট ছোট প্রাঞ্জল গদ্য রচনা।

[সম্পাদনা] তৃতীয়

এভাবে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়ে যাই। এখানে আমরা দেখি আগেকার অবোধ্য-দুর্বোধ্য শব্দকদম্ব মুখস্থ করার পরিবর্তে শিশু পরিচিত শব্দ শিখছে ও স্বচ্ছন্দ বাংলা গদ্য রচনার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। এভাবে সহজ সাবলীল ও আধুনিক বাংলা গদ্যের পথ প্রশস্ত করে দিলেন বিদ্যাসাগর সব শিক্ষিত বাঙালির জন্য।

[সম্পাদনা] চতুর্থ

চতুর্থ গুরুত্ববহ বিষয়টি হলো যতিচিহ্ন। ইতিপূর্বে বাংলা গদ্যে যতিচিহ্নের বিষয়ে সচেতনতা ও প্রয়োগ নৈপুণ্য দেখা যায়নি। বিদ্যাসাগরের এসব সাবলীল স্বচ্ছন্দ গদ্যে যতিচিহ্নের ব্যবহার লক্ষণীয়। বর্ণপরিচয়-এর ১৯ সংখ্যক পাঠ থেকে উদাহরণ টানা যায়-‘গোপাল যখন পড়িতে যায়, পথে খেলা করে না; সকলের আগে পাঠশালায় যায়; পাঠশালায় গিয়া আপনার জায়গায় বসে; আপনার জায়গায় বসিয়া, বই খুলিয়া পড়িতে থাকে; যখন গুরু মহাশয় নূতন পড়া দেন, মন দিয়া শুনে।’ যতিচিহ্নের বিষয়ে তাঁর বিশেষ সচেতনতার কথা ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় দৃষ্টান্তসহকারে উল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন- ‘তাঁহার এই সংস্কারকামী মনের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় তাঁহার বিরাম-চিহ্নের প্রয়োগের ক্রমবাহূল্য দেখিয়া।’ (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-মনীষী স্মরণে, ২ : ১৩)

[সম্পাদনা] পঞ্চম

পঞ্চম বৈশিষ্ট্য হলো, এর গদ্যাংশের মৌলিক সাহিত্য গুণ। যে ২০টি পাঠ রয়েছে তাকে বাংলা শিশুসাহিত্যের সূচনাপর্ব বলা যায়। ছোট ছোট বাক্য, তাতে ছবি যেমন তেমনি ছন্দও ফুটে ওঠে। যেমন-

 ২ পাঠ
 পথ ছাড়। জল খাও। হাত ধর। বাড়ী যাও।
 ৩ পাঠ
 কথা কয়। জল পড়ে। মেঘ ডাকে। হাত নাড়ে। খেলা করে।

এখানে প্রসঙ্গক্রমে সুনীতিকুমারের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। তিনি লিখেছেন
"বাঙ্গালা গদ্য-সার্থক বাঙ্গালা গদ্য-অনেকে লিখিয়াছেন এবং আজও অনেকে লিখিতেছে। বাঙ্গালা গদ্যের অন্তর্নিহিত ঝংকার সম্বন্ধে সচেতন হওয়া এখনকার দিনে অসম্ভব নয়। কিন্তু যখন ভালো গদ্যের নমুনা কদাচিৎ দেখা যাইত, সেইকালে বিদ্যাসাগর যে কী অনন্যসাধারণ প্রতিভাবলে বাঙ্গালা গদ্যের সেই অন্তর্নিহিত ঝংকারের সম্ভাবনা বা অস্তিত্ব আবিষ্কার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহা ভাবিলে বিস্ময়াবিষ্ট হইতে হয়।---অর্থাৎ গদ্য রচনার ছন্দবিষয়ে তিনিই ছিলেন প্রথম দ্রষ্টা ও স্রষ্টা; গদ্যপাঠের ধ্বনি-সামঞ্জস্যে যে পাঠক ও শ্রোতা আনন্দ পাইতে পারে, এই সূক্ষ্ম অনুভূতি তাঁহার ছিল।"
তাঁর গদ্যের এই গুণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
"গদ্যের পদগুলির মধ্যে একটা ধ্বনি-সামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া তাহার গতির মধ্যে একটি অনতি লক্ষ্য ছন্দঃস্রোত রক্ষা করিয়া, সৌম্য এবং সবল শব্দগুলি নির্বাচন করিয়া, বিদ্যাসাগর বাংলাকে সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা দান করিয়াছেন।"

এভাবে ধাপে ধাপে বাক্য দীর্ঘ হয়েছে, ধারাবাহিকভাবে বাক্য রচিত হয়ে অনুচ্ছেদ হয়ে উঠে শেষে কাহিনীর দিকে গেছে। সবই সহজ স্বচ্ছন্দ প্রাঞ্জল গদ্যে তিনি রচনা করেছেন।

[সম্পাদনা] ষষ্ঠ

এ বইয়ের ষষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, সেই ১৫০ বছর আগেও বিদ্যাসাগর তাঁর শিশুতোষ রচনায় ধর্মীয় অনুষঙ্গ টানেননি। কাহিনীর সঙ্গে ধর্মের ও ধর্ম সংস্কারে সংস্রব নেই, জোর দিয়েছেন তিনি নীতিশিক্ষার ওপর, ভালোমন্দ বুঝে সচ্চরিত্র গঠনের ওপর। সদাসৎ বোঝানোর জন্য হয়তো একটু বেশিই ব্যগ্রতা প্রকাশ পেয়েছে, রবীন্দ্রনাথ যা নিয়ে মৃদু আপত্তিও করেছেন। সেকালের ধর্মসংস্কারের বাহূল্য, আড়ম্বর ও জবরদস্তির কথা ভাবলে শিশুপাঠ্য গ্রন্থে তাঁর এই ধর্মনিরপেক্ষ মানসের প্রতিফলন দেখে বিস্মিত ও আপ্লুত হতে হয়।

[সম্পাদনা] সপ্তম

সপ্তম বিষয়টি হলো, বিদ্যাসাগর আধুনিক শিক্ষক-শিক্ষণেরও যেন পথিকৃৎ। তিনি পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের জন্য বেশ কিছু পরামর্শও লিখে গেছেন। বর্ণপরিচয়-এর দুটি ভাগেই বর্ণযোজনার নির্দেশিকা দিয়েছেন বিদ্যাসাগর। বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগের ষষ্টিতম সংস্করণের বিজ্ঞাপনে তিনি শিক্ষকদের জন্যই লেখেন, ‘প্রায় সর্বত্র দৃষ্ট হইয়া থাকে, বালকেরা, অ, আ, এই দুই বর্ণস্থলে স্বরের অ, স্বরের আ, বলিয়া থাকে। যাহাতে তাহারা সেরূপ না বলিয়া কেবল অ, আ, এইরূপ বলে, তদ্রূপ উপদেশ দেওয়া আবশ্যক।’

একটা সমালোচনা ওঠে বর্ণপরিচয় সম্পর্কে, তাহলো শিশুরা স্বভাবত ছন্দের প্রতি বিশেষভাবে আসক্ত হলেও এ বইয়ে সরাসরি ছন্দোবদ্ধ ছড়া বা কবিতা নেই। আমরা আগেই বলেছি, তাঁর গদ্যে ছন্দের আভাস পাওয়া যায়, যা শিশুমনকে আকৃষ্ট করবে। তবুও বলতে হয়, শিশুর জন্য ছড়া ও কবিতার স্বাদ এতে নিশ্চয়ই মিলবে না।

[সম্পাদনা] প্রচার ও কার্যকারিতা

বর্ণপরিচয় যে অত্যন্ত কার্যকর হয়েছিল তা এর কাটতি ও জনপ্রিয়তা দেখেই বোঝা যায়। ১৮৫৫ থেকে বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (১৮৯১) মোট ৩৫ বছরে বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ-এর ১৫২টি মুদ্রণ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম তিন বছরে ১১টি সংস্করণে ৮৮ হাজার কপি মুদ্রিত হয়েছিল। পাঠকের কৌতূহল নিবৃত্ত করার জন্য বলা যায়, এ বইয়ের প্রথম সংস্করণ ছাপা হয়েছিল ৩ হাজার কপি। সেকালের হিসাবে যথেষ্ট বলতে হবে এ সংখ্যাকে। ১৮৬৭ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে ১২৭টি সংস্করণে এ বই মুদ্রিত হয়েছে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার কপি। অর্থাৎ এ সময় বছরে গড়ে বর্ণপরিচয় মুদ্রিত হয় ১ লাখ ৪০ হাজার কপি। বলাবাহূল্য, এ কাটতি বা জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারেরও একটা প্রত্যক্ষ সম্র্পক রয়েছে।