বাংলা বর্ণমালা
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বাংলা বর্ণ পরিচয়ের ১৫০ বছর
১ - শিক্ষার্থী এবং তাদের মা-বাবার কাছে মাতৃভাষা বাংলা এখন দুয়োরানী। সুয়োরানী ইংরেজি ভাষা। সংখ্যাগত দিক থেকে এখনো বাংলামাধ্যম স্কুলেই ছাত্র বেশি বটে, কিন্তু তাদের মনে হীনমন্যতার বোধটা ঢুকিয়ে দেওয়া গ্যাছে ভালোভাবে, ইংরেজি না পারলে শিক্ষার্থীরা অপ্রতিভ বোধ করে, অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে আফসোস করতে থাকেন। এ মনোভাবের কারণে মাতৃভাষা বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে উদাসীন্য ও চরম ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। মাতৃভাষার বিনিময়ে ইংরেজি শেখার চেষ্টা ও পণ করেছে শিক্ষিত বাঙালী।
বাংলাভাষার আজ দুর্দিন। যেন নিজ বাসভূমে পরবাসী। মাতৃভাষার সঙ্গে সম্পর্কটা অনেকটাই প্রাকৃতিক, আলো-বাতাসের মতো অসচেতন অধীকারে একে ভোগ ও ব্যবহার করা যায়। মাতৃভাষার সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কের দুটো সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য দেখি-আনন্তর্য (immediacy) এবং স্বতঃস্কূর্ততা। এটুকু হলো মূলত জৈবিক ও আবেগিক সম্পর্ক। কেবল এটুকুতে কথ্য আঞ্চলিক প্রায় উপভাষার পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকতে হয়। প্রথমত, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ভাব বিনিময়, গভীর চিন্তার প্রকাশ, যুক্তির পারম্পর্যে গভীর ও ব্যাপ্ত কোনো বিষয় উপস্থাপনের উপযোগী প্রমিত গদ্যচর্চার প্রয়োজন হয় মানবসমাজে।
দ্বিতীয়ত, মানব সংস্কৃতিতে প্রমিতকরণ একটি স্বাভাবিক ও প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য। এ কাজটি কেবল জৈবিক তাগিদ ও আবেগিক প্রেরণায় সম্পাদন করা সম্ভব নয়। এটা সচেতন যুক্তিবিচার ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে গড়ে ওঠা বিজ্ঞান। এভাবে মানুষের স্বতঃস্কূর্ত ভাব প্রকাশের তাত্ক্ষণিক প্রক্রিয়া মুখের ভাষা কাগজে-কলমে স্থায়ী রূপ পেতে পেতে বিজ্ঞানের রূপ নেয়।
বাঙালী আবেগপ্রবণ তা আমরা জানি, আর তাই তার বিজ্ঞানমনস্কতা ও চর্চার দুর্বলতার কথাও ধরে নেয়া যায়। বহূ শতাব্দী আগে পাণিনির মতো দুর্ধর্ষ ভাষাবিজ্ঞানীর দেখা পাওয়া গেছে এ উপমহাদেশে। তবে সে ছিল সংস্কৃতভাষার যুগ। সংস্কৃতে আরো পন্ডিত ভাষাবিজ্ঞানীর দেখা মিলেছে।
প্রাকৃতের বাতাবরণে সংস্কৃতভাষার গর্ভে বাংলাভাষার জন্ম। এ তো আর একদিনে কারো ইচ্ছায় গড়ে ওঠেনি, কালে কালে মুখে মুখে এবং কিছুটা বা লিখিত চর্চায় ভাষা বিকশিত হয়েছে। তবে রীতিমতো চর্চার জন্য চাই ভাষার স্বতন্ত্র স্বাধীন পূর্ণাঙ্গ রূপদান, যা আবার চর্চার মাধ্যমে ধীরে ধীরে অর্জিত হবে। কিন্তু বিপুল তত্সম শব্দের সূত্রে যেমন সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলাভাষার যোগ গভীর ও শাশ্বত তেমনি আবার আজও বাংলা ব্যাকরণ হয়ে আছে কেবলই সংস্কৃতনির্ভর।
২ - ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলাভাষার, বিশেষত বাংলা গদ্যের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রধান পুরুষ ও অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। তিনিই প্রথম বাংলাভাষার পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ লিখেছেন, যা মূলত সংস্কৃত ব্যাকরণেরই প্রসারণ হলেও আজ অব্ধি বাংলাভাষার ব্যাকরণ এই আদলের মধ্যেই রয়েছে। প্রয়াত হূমায়ুন আজাদ একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন পূর্ণাঙ্গ বাংলাভাষার ব্যাকরণ রচনার আগ্রহ ও প্রয়োজনীয়তার কথা অনেকবার বললেও কাজটি শেষ পর্যন্ত আরদ্ধই রয়ে গেছে, সম্ভবত যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিছক একজন সাহিত্যিক ছিলেন না, যদিও সাহিত্য তিনি রচনা করেছেন। তাঁর মূল ভূমিকা হচ্ছে সমাজ সংগঠক ও সংস্কারকের। একদিকে হিন্দু সমাজের ধর্মীয় সামাজিক প্রথা, বিশেষত নারীর প্রতি বৈরী গোঁড়ামি রদ করার জন্য তিনি লিখে ও কাজ করে অভিযান চালিয়েছেন, আর অন্যদিকে সমাজকে সংস্কারমুক্ত করতে ও এগিয়ে নিতে তিনি শিক্ষা বিস্তারের জন্য কাজ করেছেন। সেখানেও সর্বসাধারণের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা, গ্রন্থ রচনা, কলেজ পরিচালনার পাশাপাশি নারীশিক্ষার জন্য বিস্তর পরিশ্রম করেছেন। বিদ্যাসাগর বাঙালি সমাজে নারীমুক্তির কাজে কেবল অগ্রদূত নন, বাঙালি পুরুষদের মধ্যে আজও অনন্য এক ব্যক্তি।
শিক্ষা বিস্তারে বিদ্যাসাগরের একটি মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বাংলা প্রাইমার রচনা। তাঁর রচিত বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশের সার্ধশতবছর উপলক্ষে তাঁকে আজ বিশেষভাবে স্মরণ করছি ও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয় ১ বৈশাখ, ১২৬২ বঙ্গাব্দে, ইংরেজি ১৩ এপ্রিল ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে। কলকাতার ১ নম্বর কলেজ স্কোয়ারের ‘সংস্কৃতযন্ত্র’ নামের প্রেস থেকে ২০টি পাঠে বিভক্ত ৩০ পৃষ্ঠার এ বইটির দাম ছিল ‘দুই পয়সা’ মাত্র! বিদ্যাসাগরের এই ক্ষীণতনু স্বল্পমূল্যের বইটি সমাজে তার ভূমিকা ও প্রভাবের দিক থেকে অতুলনীয়।
আধুনিক বাংলাভাষা ও সাহিত্যের বিকাশের পেছনে এ বইটির ভূমিকা যেন জন্মদাত্রীর। আমরা লিখিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জগতে তাঁর হাত ধরেই প্রবেশ করলাম। হরিপ্রসাদ শাস্ত্রী যথার্থই লিখেছেন, ‘ইনি সর্বপ্রথম বাঙ্গালীকে বিশুদ্ধ বাঙ্গালা শিখাইয়াছেন।’ রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরকে আখ্যায়িত করেছেন ‘বাংলাভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী’ হিসেবে। কারণ তিনিই ‘সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন।’ [বিদ্যাসাগর চরিত] আর আচার্য সুনীতিকুমারের ভাষায়, ‘বাঙ্গালা গদ্যে প্রতিভার প্রথম স্মরণ-বিদ্যাসাগর।’
মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগের ১৬টি স্বরবর্ণ
ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের ১৬টি থেকে কমিয়ে ১২টি স্বরবর্ণ মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগের ৩৪টি ব্যাঞ্জনবর্ণ ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগে নির্দেশিত ৪০টি ব্যাঞ্জনবর্ণ
৩ - বাঙালীর শিক্ষা-দীক্ষার পটভূমি বিচার করলেই বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠবে। মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যে বর্ণিত শ্রীমন্তের শিক্ষারম্ভ থেকে আমরা অন্তত ষোড়শ শতকের বাংলায় শিশুর শিক্ষার সূচনাপর্বের একটা চিত্র পেয়ে যাই। পাঁচ বছরের শিশুকে গুরুর পাঠশালায় হাতেখড়ি দেওয়া হতো এবং সেখানে এই শিশু শিক্ষার্থী গুরুর কাছে মুখে মুখে এবং হাতে লেখা পুথি থেকে ভাষা, নীতি এবং জমিজমা ও ব্যবসা সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ, বাক্য, শ্লোক ইত্যাদি পড়ত, মূলত মুখস্থ করত। মুদ্রণযন্ত্র স্থাপিত হওয়ার পর প্রথম একটি বাধা ছিল পাশ্চাত্যের যন্ত্রে মুদ্রিত গ্রন্থপাঠে জাত যাবে-এ রকম কুসংস্কার। অন্যদিকে দেখা যায়, রাধাকান্ত দেব রচিত বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ (১৮২১) বইটিতে বর্ণমালা, ব্যাকরণ, ইতিহাস, ভূগোল, গণিত ইত্যাদি বিষয়ের সমাবেশ ঘটেছে ও বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮৮! যে কারো ক্ষেত্রে-শিশু বা বৃদ্ধ-শিক্ষাজীবন শুরু করার জন্য এ রকম ঢাউস ও গুরুগম্ভীর বইকে উপযুক্ত ভাবার কোনো উপায় নেই।
বিদ্যাসাগরের আগে বর্ণমালা শেখার যেসব বই রচিত ও প্রকাশিত হয়েছিল তার অধিকাংশই বস্তুতপক্ষে শিশুর বাংলা প্রথম পাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। শ্রীরামপুর মিশনের লিপিধারা (১৮১৫), জ্ঞানারুণোদয় (১৮২০), রামমোহন রায়ের গৌড়ীয় ব্যাকরণ (১৮৩৩), শিশুবোধক, বঙ্গবর্ণমালা (১৮৩৫), রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের শিশুসেবধি, বর্ণমালা ( (১৮৪০), কলিকাতা স্কুল বকু সোসাইটির বর্ণমালা প্রথম ভাগ (১৮৫৩), ও দ্বিতীয় ভাগ (১৮৫৪) এবং হ্যালহেডের এ গ্রামার অফ দি বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজসহ (১৭৬৮) অন্যান্য বইয়ের মধ্যে বিদ্যাসাগরের পূর্ববর্তী বাংলাভাষা শিক্ষার প্রথম পাঠ হিসেবে সর্বাগ্রে নাম করতে হবে বিদ্যাসাগরেরই সুহৃদ পন্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ (১৮৪৯) বইটির। শিশুর প্রথম পাঠ হিসেবে এটি উল্লেখযোগ্য বই।
ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় বাংলা প্রাইমার লেখায় যে জোয়ার এসেছিল তার কারণ ঔপনিবেশিক ইংরেজ সরকার তাদেরই প্রয়োজনে একটি শিক্ষিত শ্রেণী গড়ে তুলতে চেয়েছিল। শাসনকাজের প্রয়োজনে শাসিত প্রজাদের মধ্যে যেমন ইংরেজি জানা একটা শ্রেণীর প্রয়োজন তেমনি শাসক ইংরেজ ও প্রজাকুলের এই শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে স্থানীয় অর্থাৎ বাংলাভাষা চর্চারও প্রয়োজনীয়তা ছিল। বস্তুত ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি জ্ঞানার্জন ও তা চর্চার কোনো বিকল্প ছিল না। এ কাজে মাতৃভাষার চর্চাও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছিল।
ওই সময় শিক্ষা বিস্তার, স্কুল প্রতিষ্ঠা, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশের জন্য অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। আমরা জানি শিক্ষা নিয়ে এ সময় অনেক কমিশনও গঠিত হয়, যারা জরিপ চালিয়ে প্রকৃত অবস্থা জেনে করণীয় নির্ধারণ করতে চেয়েছে। এসব প্রতিবেদনে শিক্ষা বিস্তারে অগ্রগতির অন্তরায় হিসেবে প্রায়ই পাঠ্যবইয়ের অভাবের কথা বলা হয়। ১৮৫২খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুন সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়-এর সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘গভর্নমেন্টের যে কয়টা পাঠশালা আছে তাহাতে বাংলাভাষা শিক্ষা দিবার শৃঙ্খলামাত্র নাই।---ভাষা শিক্ষার নিমিত্ত কেবল বর্ণমালা, নীতিকথা ইত্যাদি দুই-তিনখানি পুস্তক ভিন্ন অন্য পুস্তক পাঠ হয় না, তাহাতে ভাষার সম্যক জ্ঞান বৃদ্ধির কেমন সম্ভাবনা পাঠকবর্গ বুঝিতে পারিবেন।’ আবার বিভিন্ন সরকারি প্রতিবেদনে উপযুক্ত পাঠ্যবইয়ের অভাবে স্কুলে ছাত্রসংখ্যা কমে যাওয়ার কথাও উল্লিখিত হতে দেখা যায়। সব মিলিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে একটা ভালো বাংলা প্রাইমারের চাহিদা তৈরি হয়। ঠিক এই সময় বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয় রচনা ও প্রকাশ করেন।
৪ - শিশুদের জন্য বর্ণপরিচয় রচনার গোড়ায়ই এসে পড়ে বর্ণমালার কথা। আমরা জানি ব্রাহ্মীলিপি থেকেই বিবর্তিত হয়ে বাংলা বর্ণমালার উদ্ভব হয়েছে। এ বিবর্তন প্রক্রিয়া চলেছে তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে। তবে বলা যেতে পারে, বিদ্যাসাগরের হাতেই বাংলা বর্ণমালার যথাযথ উন্নতি হয়েছে, যে মৌলিক উন্নয়নের পর পরবর্তী সার্ধশতবছরে মাত্র কিছু সংস্কারমূলক কাজ হয়েছে। তাঁকে প্রথমত বর্ণমালার প্রকৃতি ও সংখ্যা নির্ধারণ করতে হয়েছে। ১৭৬৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হ্যালহেডের বইয়ে স্বরবর্ণের সংখ্যা ছিল ১৬। পরবর্তী প্রায় ১০০ বছর-মদনমোহনের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ (প্রকাশকাল ১৮৪৯) পর্যন্ত স্বরবর্ণের সংখ্যা ১৬টিই ছিল। এগুলো হলো অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, ঋৃ, ৯, ৯৯, এ, ঐ, ও, ঔ, অ০, অঃ। বিদ্যাসাগর এই সংখ্যা কমিয়ে ১২তে নামালেন। তিনি ভূমিকায় লিখলেন, ‘বহূকালাবধি বর্ণমালা ষোল স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন এই পঞ্চাশ অক্ষরে পরিগণিত ছিল। কিন্তু বাঙ্গালা ভাষায় দীর্ঘ ঋৃ-কার ও দীর্ঘ ৯৯ কারের প্রয়োজন নাই। এই নিমিত্ত ঐ দুই বর্ণ পরিত্যক্ত হইয়াছে। আর সবিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিলে অনুস্বার ও বিসর্গ স্বরবর্ণ মধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না। এই নিমিত্ত ঐ দুই বর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ মধ্যে পঠিত হইয়াছে।’ বিদ্যাসাগরের এই মৌলিক সংস্কারের ১২৫ বছর পর স্বরবর্ণে মাত্র আর একটি সংস্কার ঘটেছে, তাহলো ৯ বর্ণটি বাদ দেওয়া। এখন স্বরবর্ণ ১১টি। ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল ৩৪টি। বিদ্যাসাগর তাতে নতুনভাবে ছয়টি বর্ণ যুক্ত করেন। আগেই বলেছি, অনুস্বার ও বিসর্গকে স্বরবর্ণ থেকে তিনি ব্যঞ্জনবর্ণে নিয়ে এসেছিলেন। ‘আর চন্দ্রবিন্দুকে ব্যঞ্জনবর্ণে এক স্বতন্ত্র বর্ণ বলিয়া গণনা করা গিয়াছে। ড, ঢ, য এই তিন ব্যঞ্জনবর্ণ পদমধ্যে অথবা পদান্তে থাকিলে ড়, ঢ়, য় হয়। সুতরাং অভিন্ন বর্ণ বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে।’ (ভূমিকা, বর্ণপরিচয়)। তা ছাড়া বিদ্যাসাগর দেখলেন, ‘বাঙ্গালা ভাষায় একারের ত, ত্ এই দ্বিবিধ কলেবর প্রচলিত আছে।’ তাই এটিকেও ব্যঞ্জনবর্ণে যুক্ত করেছেন। আর ক্ষ যেহেতু ক ও ষ মিলে হয় ‘সুতরাং উহা সংযুক্তবর্ণ, এ জন্য অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ গণনাস্থলে পরিত্যক্ত হইয়াছে।’ এভাবে তাঁর হাতে ব্যঞ্জনবর্ণ হলো ৪০টি।
এরপর আবারও ১২৫ বছরে কেবল অন্তস্থ ‘ব’ টি ব্যঞ্জন থেকে বাদ গিয়েছে। ফলে বলা যায়, আধুনিক বাংলা বর্ণমালার মূল রূপকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
তাঁর বর্ণপরিচয়-এর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এই প্রথম শিশুদের উপযোগী সহজবোধ্য ও সংক্ষিপ্ত বাক্য দিয়ে পাঠ রচনা করা হয়েছে। এখানে প্রথমে শিশু বর্ণক্রমিক পদ্ধতিতে বর্ণ শিখবে, বর্ণের সঙ্গে মুখে মুখে ছোট ছোট শব্দ শিখবে, এরপর বর্ণপরিচয়-এর পরীক্ষা, তারপর বর্ণযোজনা ও ফলা সংযোগে বানান শেখার সূচনা। এরপর রয়েছে সহজবোধ্য ছোট বাক্যের ছোট ছোট প্রাঞ্জল গদ্য রচনা।
এভাবে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়ে যাই। এখানে আমরা দেখি আগেকার অবোধ্য-দুর্বোধ্য শব্দকদম্ব মুখস্থ করার পরিবর্তে শিশু পরিচিত শব্দ শিখছে ও স্বচ্ছন্দ বাংলা গদ্য রচনার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। এভাবে সহজ সাবলীল ও আধুনিক বাংলা গদ্যের পথ প্রশস্ত করে দিলেন বিদ্যাসাগর সব শিক্ষিত বাঙালির জন্য।
চতুর্থ গুরুত্ববহ বিষয়টি হলো যতিচিহ্ন। ইতিপূর্বে বাংলা গদ্যে যতিচিহ্নের বিষয়ে সচেতনতা ও প্রয়োগ নৈপুণ্য দেখা যায়নি। বিদ্যাসাগরের এসব সাবলীল স্বচ্ছন্দ গদ্যে যতিচিহ্নের ব্যবহার লক্ষণীয়। বর্ণপরিচয়-এর ১৯ সংখ্যক পাঠ থেকে উদাহরণ টানা যায়-‘গোপাল যখন পড়িতে যায়, পথে খেলা করে না; সকলের আগে পাঠশালায় যায়; পাঠশালায় গিয়া আপনার জায়গায় বসে; আপনার জায়গায় বসিয়া, বই খুলিয়া পড়িতে থাকে; যখন গুরু মহাশয় নূতন পড়া দেন, মন দিয়া শুনে।’ যতিচিহ্নের বিষয়ে তাঁর বিশেষ সচেতনতার কথা ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় দৃষ্টান্তসহকারে উল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন- ‘তাঁহার এই সংস্কারকামী মনের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় তাঁহার বিরাম-চিহ্নের প্রয়োগের ক্রমবাহূল্য দেখিয়া।’ (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-মনীষী স্মরণে, ২ : ১৩)
পঞ্চম বৈশিষ্ট্য হলো, এর গদ্যাংশের মৌলিক সাহিত্য গুণ। যে ২০টি পাঠ রয়েছে তাকে বাংলা শিশুসাহিত্যের সূচনাপর্ব বলা যায়। ছোট ছোট বাক্য, তাতে ছবি যেমন তেমনি ছন্দও ফুটে ওঠে। যেমন-
২ পাঠ পথ ছাড়। জল খাও। হাত ধর। বাড়ী যাও। ৩ পাঠ কথা কয়। জল পড়ে। মেঘ ডাকে। হাত নাড়ে। খেলা করে।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে সুনীতিকুমারের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ‘বাঙ্গালা গদ্য-সার্থক বাঙ্গালা গদ্য-অনেকে লিখিয়াছেন এবং আজও অনেকে লিখিতেছে। বাঙ্গালা গদ্যের অন্তর্নিহিত ঝংকার সম্বন্ধে সচেতন হওয়া এখনকার দিনে অসম্ভব নয়। কিন্তু যখন ভালো গদ্যের নমুনা কদাচিৎ দেখা যাইত, সেইকালে বিদ্যাসাগর যে কী অনন্যসাধারণ প্রতিভাবলে বাঙ্গালা গদ্যের সেই অন্তর্নিহিত ঝংকারের সম্ভাবনা বা অস্তিত্ব আবিষ্কার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহা ভাবিলে বিস্ময়াবিষ্ট হইতে হয়।---অর্থাৎ গদ্য রচনার ছন্দবিষয়ে তিনিই ছিলেন প্রথম দ্রষ্টা ও স্রষ্টা; গদ্যপাঠের ধ্বনি-সামঞ্জস্যে যে পাঠক ও শ্রোতা আনন্দ পাইতে পারে, এই সূক্ষ্ম অনুভূতি তাঁহার ছিল।’ তাঁর গদ্যের এই গুণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘গদ্যের পদগুলির মধ্যে একটা ধ্বনি-সামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া তাহার গতির মধ্যে একটি অনতি লক্ষ্য ছন্দঃস্রোত রক্ষা করিয়া, সৌম্য এবং সবল শব্দগুলি নির্বাচন করিয়া, বিদ্যাসাগর বাংলাকে সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা দান করিয়াছেন।’
এভাবে ধাপে ধাপে বাক্য দীর্ঘ হয়েছে, ধারাবাহিকভাবে বাক্য রচিত হয়ে অনুচ্ছেদ হয়ে উঠে শেষে কাহিনীর দিকে গেছে। সবই সহজ স্বচ্ছন্দ প্রাঞ্জল গদ্যে তিনি রচনা করেছেন।
এ বইয়ের ষষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, সেই ১৫০ বছর আগেও বিদ্যাসাগর তাঁর শিশুতোষ রচনায় ধর্মীয় অনুষঙ্গ টানেননি। কাহিনীর সঙ্গে ধর্মের ও ধর্ম সংস্কারে সংস্রব নেই, জোর দিয়েছেন তিনি নীতিশিক্ষার ওপর, ভালোমন্দ বুঝে সচ্চরিত্র গঠনের ওপর। সদাসৎ বোঝানোর জন্য হয়তো একটু বেশিই ব্যগ্রতা প্রকাশ পেয়েছে, রবীন্দ্রনাথ যা নিয়ে মৃদু আপত্তিও করেছেন। সেকালের ধর্মসংস্কারের বাহূল্য, আড়ম্বর ও জবরদস্তির কথা ভাবলে শিশুপাঠ্য গ্রন্থে তাঁর এই ধর্মনিরপেক্ষ মানসের প্রতিফলন দেখে বিস্মিত ও আপ্লুত হতে হয়।
সপ্তম বিষয়টি হলো, বিদ্যাসাগর আধুনিক শিক্ষক-শিক্ষণেরও যেন পথিকৃৎ। তিনি পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের জন্য বেশ কিছু পরামর্শও লিখে গেছেন। বর্ণপরিচয়-এর দুটি ভাগেই বর্ণযোজনার নির্দেশিকা দিয়েছেন বিদ্যাসাগর। বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগের ষষ্টিতম সংস্করণের বিজ্ঞাপনে তিনি শিক্ষকদের জন্যই লেখেন, ‘প্রায় সর্বত্র দৃষ্ট হইয়া থাকে, বালকেরা, অ, আ, এই দুই বর্ণস্থলে স্বরের অ, স্বরের আ, বলিয়া থাকে। যাহাতে তাহারা সেরূপ না বলিয়া কেবল অ, আ, এইরূপ বলে, তদ্রূপ উপদেশ দেওয়া আবশ্যক।’
একটা সমালোচনা ওঠে বর্ণপরিচয় সম্পর্কে, তাহলো শিশুরা স্বভাবত ছন্দের প্রতি বিশেষভাবে আসক্ত হলেও এ বইয়ে সরাসরি ছন্দোবদ্ধ ছড়া বা কবিতা নেই। আমরা আগেই বলেছি, তাঁর গদ্যে ছন্দের আভাস পাওয়া যায়, যা শিশুমনকে আকৃষ্ট করবে। তবুও বলতে হয়, শিশুর জন্য ছড়া ও কবিতার স্বাদ এতে নিশ্চয়ই মিলবে না।
৫ - বর্ণপরিচয় যে অত্যন্ত কার্যকর হয়েছিল তা এর কাটতি ও জনপ্রিয়তা দেখেই বোঝা যায়। ১৮৫৫ থেকে বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (১৮৯১) মোট ৩৫ বছরে বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ-এর ১৫২টি মুদ্রণ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম তিন বছরে ১১টি সংস্করণে ৮৮ হাজার কপি মুদ্রিত হয়েছিল। পাঠকের কৌতূহল নিবৃত্ত করার জন্য বলা যায়, এ বইয়ের প্রথম সংস্করণ ছাপা হয়েছিল ৩ হাজার কপি। সেকালের হিসাবে যথেষ্ট বলতে হবে এ সংখ্যাকে। ১৮৬৭ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে ১২৭টি সংস্করণে এ বই মুদ্রিত হয়েছে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার কপি। অর্থাৎ এ সময় বছরে গড়ে বর্ণপরিচয় মুদ্রিত হয় ১ লাখ ৪০ হাজার কপি। বলাবাহূল্য, এ কাটতি বা জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারেরও একটা প্রত্যক্ষ সম্র্পক রয়েছে।
আজকের দিনে বর্ণক্রমিক ভাষাশিক্ষার পরিবর্তে বাক্যক্রমিক পদ্ধতি চালু হয়েছে। শিশুর ভাষা শেখার যে স্বাভাবিক পদ্ধতি তার ওপর ভিত্তি করেই দেশে-বিদেশে এ পদ্ধতি গৃহীত হয়েছে। শতাধিক বছরব্যাপী শিশুর প্রথম পাঠ হিসেবে এ বইটি প্রায় একচ্ছত্র প্রাধান্য বজায় রেখেছে। এর পাশাপাশি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ এবং আরো পরে রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা বাঙালি বাড়িতে শিশুদের প্রথম পাঠের বই হিসেবে বহূকাল প্রচলিত ছিল। বলা যায় ভাষাশিক্ষার নতুন কালে প্রবেশ করে আমরা বর্ণপরিচয়ের কালকে পেছনে ফেলে এসেছি।
কিন্তু শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের অনন্যসাধারণ ভূমিকার কথা আমরা যেন ভুলে না যাই। কীভাবে বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণের বিজ্ঞানসিদ্ধ সংস্কার করে ভাষাচর্চার পথকে সুগম করেছেন তার গুরুত্ব কেবল ঐতিহাসিক নয়, ভাষাতাত্ত্বিকও। তা ছাড়া শিশুতোষ গদ্য রচনার সূত্রপাত করে তিনি কেবল বাঙালির ঘরে ঘরে শিশুদের শিক্ষার পথে আকৃষ্ট করেছেন তা নয়, বাংলা শিশুসাহিত্যের গোড়াপত্তনও করেছেন। বাংলাভাষার সমৃদ্ধ শিশু সাহিত্যেরও পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ফলে সার্ধশতবর্ষ অতিক্রান্ত হলেও এ বইটি এখনো তার পাঠযোগ্যতা হারায়নি।
আধুনিক বাঙালি মানসের অগ্রদূত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হলো বর্ণপরিচয় রচনা-শিক্ষিত আধুনিক বাঙালি জাতি বিনির্মাণে এ বই তার প্রথম মানসপুষ্টির যোগান দিয়েছে।